ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা

- শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও লীলাগুলি হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লীলাগুলি শুধুমাত্র পৌরাণিক ঘটনা নয়, বরং এগুলি মানবজীবনের আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণের লীলাগুলি মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত:
- শৈশব লীলা (বাল্যকাল)
- বৃন্দাবন লীলা (কৈশোরকাল)
- মথুরা লীলা (যৌবনকাল
- দ্বারকা লীলা (রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন)
- এই লীলাগুলি মহাভারত, ভাগবত পুরাণ এবং অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিচে শ্রীকৃষ্ণের লীলাগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল:
১. শৈশব লীলা (বাল্যকাল):
- শ্রীকৃষ্ণের শৈশব লীলা তাঁর জন্ম থেকে শুরু হয় এবং তাঁর বাল্যজীবনের ঘটনাগুলি ধরে রাখে। এই লীলাগুলি তাঁর ঈশ্বরীয় শক্তি ও প্রেমের প্রতীক।
- ক. জন্ম:
- শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় দ্বাপর যুগে, মথুরায়। তিনি দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম পুত্র ছিলেন।
- কংস, দেবকীর ভাই এবং মথুরার অত্যাচারী রাজা, দেবী দুর্গার ভবিষ্যদ্বাণী শুনে জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁকে হত্যা করবে। এই ভয়ে কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদের সমস্ত সন্তানকে হত্যা করেন।
- শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাতে দেবী দুর্গার আশীর্বাদে বসুদেব শিশু শ্রীকৃষ্ণকে গঙ্গার জলের উপর দিয়ে নন্দ ও যশোদার কাছে নিয়ে যান। নন্দ ও যশোদা তাঁকে তাদের পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
- খ. পুতনা বধ:
- শিশু শ্রীকৃষ্ণ পুতনা নামে এক রাক্ষসীকে হত্যা করেন। কংস পুতনাকে শিশু শ্রীকৃষ্ণকে মারার জন্য পাঠায়। পুতনা দুগ্ধ দিয়ে শিশু শ্রীকৃষ্ণকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তার স্তন ধরে তার জীবনশক্তি শুষে নেন।
- গ. তৃণাবর্ত লীলা:
- শ্রীকৃষ্ণ একদিন তৃণাবর্ত (চাকা) দিয়ে খেলছিলেন। তিনি চাকাটি ঘুরিয়ে ফেলেন এবং তার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন। যশোদা তাঁকে বাঁচানোর জন্য চাকাটি ভেঙে ফেলেন।
- ঘ. কালিয়া দমন:
- বৃন্দাবনের কালিন্দী নদীতে কালিয়া নামে এক বিষধর সাপ বাস করত। শ্রীকৃষ্ণ গোপ-বালকদের সঙ্গে নদীতে খেলতে গিয়ে কালিয়ার মাথায় চড়ে তাকে দমন করেন। কালিয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ করে এবং তার বিষ নির্গত করে নদী পবিত্র করে।
- ঙ. গোপীদের মাখন চুরি:
- শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের গোপীদের ঘর থেকে মাখন চুরি করতেন। গোপীরা তাঁকে ধরার চেষ্টা করতেন, কিন্তু তিনি তাদের হাত থেকে পালিয়ে যেতেন। এই লীলা তাঁর প্রেম ও আনন্দের প্রতীক।
২. বৃন্দাবন লীলা (কৈশোরকাল):
- শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা তাঁর কৈশোরকালের ঘটনাগুলি ধরে রাখে। এই লীলাগুলি তাঁর প্রেম, আনন্দ ও গোপীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে প্রকাশ করে।
- ক. গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা:
- শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে রাতের বেলা রাসলীলা করতেন। এই লীলায় তিনি গোপীদের সঙ্গে নৃত্য করতেন এবং তাদের প্রেম ও ভক্তি প্রকাশ করতেন। এটি তাঁর প্রেমের লীলা হিসেবে পরিচিত।
- খ. গোবর্ধন ধারণ:
- ইন্দ্র গোপদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে ঝড় ও বৃষ্টি আনেন। শ্রৃীকৃষ্ণ গোবর্ধন পাহাড়টি তুলে ধরেন এবং গোপদের ঝড় ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেন। এই লীলা তাঁর শক্তি ও দয়ার প্রতীক।
- গ. অর্জুন ও কৃষ্ণের বন্ধুত্ব:
- শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। এই বন্ধুত্ব মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব হিসেবে পরিচিত।
৩. মথুরা লীলা (যৌবনকাল):
- শ্রীকৃষ্ণের মথুরা লীলা তাঁর যৌবনকালের ঘটনাগুলি ধরে রাখে। এই লীলাগুলি তাঁর রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রকাশ করে।
- ক. কংসকে হত্যা:
- শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় ফিরে কংসকে হত্যা করেন। তিনি কংসের অত্যাচার থেকে মথুরার মানুষকে মুক্ত করেন।
- খ. জরাসন্ধের পরাজয়:
- শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধকে পরাজিত করেন এবং মথুরার রাজ্য মুক্ত করেন।
- গ. কুঞ্জবিহারী লীলা:
- শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে কুঞ্জবনে খেলতেন এবং তাদের সঙ্গে প্রেমের লীলা করতেন।
৪. দ্বারকা লীলা (রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন):
- শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে যান এবং সেখানে তিনি একজন রাজা হিসেবে শাসন করেন। এই লীলাগুলি তাঁর রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রকাশ করে।
- ক. যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ:
- শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে সহায়তা করেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনে সহায়তা করেন।
- খ. কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ:
- শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের সারথি হিসেবে দায়িত্ব নেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি অর্জুনকে ভগবদ্গীতা শিক্ষা দেন।
- গ. শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু:
- শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয় দ্বারকায়। তাঁর মৃত্যুর পর দ্বাপর যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং কলিযুগের শুরু হয়।
উপসংহার:
- শ্রীকৃষ্ণের লীলাগুলি তাঁর ঈশ্বরীয় শক্তি, প্রেম ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতীক। এই লীলাগুলি মানবজীবনের আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষার উৎস। শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও লীলাগুলি আজও মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে।