ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন

শ্রীকৃষ্ণের দর্শন হিন্দু ধর্ম ও ভারতীয় দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি কেবলমাত্র একজন দেবতা নন, বরং একজন মহান দার্শনিক, শিক্ষক এবং জীবনদর্শনের পথপ্রদর্শক। তাঁর দর্শন ভগবদ্গীতা, মহাভারত এবং অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের মূল বিষয়গুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো:

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন

১. কর্মযোগ: কর্মের মাধ্যমে মুক্তি

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো কর্মযোগ। তিনি ভগবদ্গীতায় অর্জুনকে শিক্ষা দেন যে, ব্যক্তির উচিত ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে নিঃস্বার্থভাবে তার কর্তব্য পালন করা। তিনি বলেন:

"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।"

(তোমার কর্তব্য কর্মে অধিকার আছে, কিন্তু ফলাফলে কখনোই নেই।)

কর্মযোগের মূল বক্তব্য: ব্যক্তির উচিত নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা, কিন্তু কর্মের ফলাফলের প্রতি আসক্ত না হওয়া। এই নিঃস্বার্থ কর্মই মানুষকে আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।

২. জ্ঞানযোগ: জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি

শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানযোগের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান ও ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, সত্যিকারের জ্ঞান হলো আত্মা (আত্মন) এবং পরমাত্মা (ব্রহ্ম) এর মধ্যে একাত্মবোধ।

"নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।"

(আত্মাকে কোনো অস্ত্র কাটতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না।)

জ্ঞানযোগের মূল বক্তব্য: সত্যিকারের জ্ঞান হলো এই বোধ যে, আত্মা অবিনাশী এবং এটি শাশ্বত। এই জ্ঞান মানুষকে মোহ ও অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি দেয়।

৩. ভক্তিযোগ: ভক্তির মাধ্যমে মুক্তি

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে ভক্তিযোগের বিশেষ স্থান রয়েছে। তিনি বলেন যে, ভক্তি বা প্রেমই হলো ঈশ্বরের নিকট পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ ও সরল পথ। তিনি ভক্তদের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম ও করুণার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন।

"যৎতো ভক্তস্ততো জয়ঃ।"

(যেখানে ভক্ত, সেখানে জয়।)

ভক্তিযোগের মূল বক্তব্য: ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি, প্রেম ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মানুষ পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভক্তদের হৃদয়ে বাস করেন বলে উল্লেখ করেছেন।

৪. নিষ্কাম কর্ম: ফলাফলের প্রতি অনাসক্তি

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিষ্কাম কর্ম। তিনি বলেন যে, কর্ম করার সময় ফলাফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। এই নিষ্কাম কর্মই মানুষকে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি দেয়।

"কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্।"

(যে ব্যক্তি কর্মেন্দ্রিয়গুলি সংযত করে এবং মন দিয়ে আমাকে স্মরণ করে, সে প্রকৃত জ্ঞানী।)

নিষ্কাম কর্মের মূল বক্তব্য: কর্ম করার সময় ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ এবং ফলাফলের প্রতি অনাসক্তি হলো মুক্তির পথ।

৫. ধর্ম ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে ধর্ম ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনকে ধর্মযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বলেন যে, অধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা প্রত্যেকের কর্তব্য।

"ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।"

(ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই।)

ধর্মের মূল বক্তব্য: ধর্ম ও ন্যায়ের পথে চলা এবং অধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হলো মানুষের প্রধান কর্তব্য।

৬. আত্মা ও পরমাত্মার একাত্মবোধ

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে আত্মা (ব্যক্তির আত্মা) এবং পরমাত্মা (ঈশ্বর) এর মধ্যে একাত্মবোধের কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন যে, আত্মা অবিনাশী এবং এটি জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত।

"দেহিনোঽস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।"

(দেহের মতো আত্মাও বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্য অতিক্রম করে, কিন্তু আত্মা অবিনাশী।)

আত্মা ও পরমাত্মার মূল বক্তব্য: আত্মা ও পরমাত্মা একই সত্তার দুটি দিক। আত্মজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে পারে।

৭. সমদৃষ্টি: সমতা বোধ

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে সমদৃষ্টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন যে, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সকলকে সমান চোখে দেখেন। তিনি সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় ইত্যাদিতে সমান থাকেন।

"সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।"

(সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়কে সমানভাবে গ্রহণ করা।)

সমদৃষ্টির মূল বক্তব্য: সমস্ত পরিস্থিতিতে সমান থাকাই হলো প্রকৃত জ্ঞানীর লক্ষণ।

৮. ঈশ্বরের সর্বব্যাপীত্ব

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে ঈশ্বরের সর্বব্যাপীত্বের কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন যে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি সকলের হৃদয়ে বাস করেন।

"ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।"

(হে অর্জুন, ঈশ্বর সকল প্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন।)

সর্বব্যাপীত্বের মূল বক্তব্য: ঈশ্বর সকলের মধ্যে বিরাজমান এবং তিনি সকলের আত্মার আত্মা।

৯. জীবনের লক্ষ্য: মোক্ষলাভ

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো কর্মযোগ। তিনি ভগবদ্গীতায় অর্জুনকে শিক্ষা দেন যে, ব্যক্তির উচিত ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে নিঃস্বার্থভাবে তার কর্তব্য পালন করা। তিনি বলেন:

"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।"

(তোমার কর্তব্য কর্মে অধিকার আছে, কিন্তু ফলাফলে কখনোই নেই।)

কর্মযোগের মূল বক্তব্য: ব্যক্তির উচিত নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা, কিন্তু কর্মের ফলাফলের প্রতি আসক্ত না হওয়া। এই নিঃস্বার্থ কর্মই মানুষকে আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।

১০. প্রেম ও ভক্তির মহিমা

শ্রীকৃষ্ণের দর্শনে প্রেম ও ভক্তির বিশেষ স্থান রয়েছে। তিনি বলেন যে, ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের নিকট পৌঁছানো যায় এবং ভক্তই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।

"ভক্ত্যা মামভিজানাতি।"

(ভক্তির মাধ্যমে আমাকে জানা যায়।)

প্রেম ও ভক্তির মূল বক্তব্য: ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি ও প্রেমই হলো মুক্তির পথ।

উপসংহার:

শ্রীকৃষ্ণের দর্শন হলো কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়। তিনি মানুষকে নিঃস্বার্থ কর্ম, আত্মজ্ঞান ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তাঁর দর্শন শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং নৈতিক, দার্শনিক ও সামাজিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা আজও মানুষের জীবনকে প্রেরণা ও পথনির্দেশনা দিয়ে চলেছে।