মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের

শ্রীকৃষ্ণ, মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র, হিন্দু ধর্মের একজন মূল দেবতা ও আদর্শ জীবনের প্রতীক। তিনি কেবল একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন, বরং তিনি একজন দার্শনিক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা, আধ্যাত্মিক গুরু এবং একজন অসাধারণ সামরিক কৌশলবিদ। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা অত্যন্ত বহুমুখী এবং তিনি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করেছেন।

মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও পূর্ব জীবন:

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় দ্বাপর যুগে, মথুরায়, কংস নামে এক অত্যাচারী রাজার শাসনামলে। কংস ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মাতা দেবকীর ভাই। এক দিন দেবী দুর্গা কংসকে সতর্ক করেন যে দেবকীর অষ্টম সন্তান তাকে হত্যা করবে। ভয়ে কংস দেবকী ও তাঁর স্বামী বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদের সমস্ত সন্তানকে হত্যা করেন। তবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদে দেবকীর অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ জন্মের পরই তাঁকে গোপনে নন্দ ও যশোদার কাছে পাঠানো হয়। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে গোপ-গোপীদের মধ্যে বড় হন এবং তাঁর বাল্যজীবন পূর্ণ ছিল আনন্দ, খেলা ও কৃষ্ণের সঙ্গে গোপীদের প্রেমের কাহিনী দিয়ে।

শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের ঘটনাগুলি যেমন কালিয়া দমন, গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা, কংসকে হত্যা করা ইত্যাদি মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ঘটনাগুলি শ্রীকৃষ্ণের শক্তি, বুদ্ধি এবং তাঁর ঈশ্বরীয় প্রকৃতির প্রতীক।

শ্রীকৃষ্ণ ও মহাভারত:

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রধান চরিত্র এবং তাঁর উপদেশ ও কৌশল যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে।

১. পাণ্ডবদের সহায়:

শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের অন্যতম বন্ধু ও সহায় ছিলেন। তিনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অত্যাচারী কৌরবদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও তিনি যুদ্ধে সরাসরি অস্ত্রধারণ করেননি, তবে তাঁর কৌশল ও উপদেশ পাণ্ডবদের জয়ের পথ প্রশস্ত করেছিল।

২. অর্জুনের সারথি:

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হিসেবে দায়িত্ব নেন। যুদ্ধের পূর্বে অর্জুন তার আত্মীয় ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হন এবং তার মনে দ্বিধা ও দুঃখের উদ্রেক হয়। এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক উপদেশ দেন, যা ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত। এই উপদেশের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্তব্য পালন করতে উৎসাহিত করেন এবং তাঁকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান দেন।

৩. যুদ্ধের কৌশলবিদ:

শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন একজন অসাধারণ কৌশলবিদ। তিনি পাণ্ডবদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রণয়ন করেন। যেমন:

অভিমন্যুর মৃত্যু: কৌরবদের পক্ষে অভিমন্যু ছিলেন একজন অসাধারণ যোদ্ধা। শ্রীকৃষ্ণ অভিমন্যুর মৃত্যুর কৌশল প্রণয়ন করেন।

ভীষ্মদেবের পতন: শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে পরাজিত করার জন্য একটি কৌশল প্রণয়ন করেন, যেখানে অর্জুন শিখার বাণ দিয়ে ভীষ্মদেবকে আহত করেন।

দ্রোণাচার্যের পতন: শ্রীকৃষ্ণ দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বথামার মৃত্যুর ভান করে দ্রোণাচার্যকে অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

৪. শান্তির প্রচেষ্টা:

শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ শুরুর আগে শান্তির চেষ্টা করেছিলেন। তিনি কৌরবদের কাছে গিয়ে পাণ্ডবদের জন্য সামান্য অধিকার চান, কিন্তু কৌরবরা তা গ্রহণ করেননি। এই ঘটনা থেকে শ্রীকৃষ্ণের শান্তির প্রতি আগ্রহ এবং তাঁর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়।

শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উপদেশ:

শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি অর্জুনকে ভগবদ্গীতায় নিম্নলিখিত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেন:

নিষ্কাম কর্ম:

শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে মানুষ তার কর্তব্য পালন করবে, কিন্তু কর্মের ফল আশা করবে না। কর্মফলের প্রতি আসক্তি ছাড়াই কর্ম করা উচিত।

আত্মজ্ঞান:

শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে আত্মা অবিনশ্বর এবং শরীর ক্ষণস্থায়ী। মানুষ যদি এই সত্য বুঝতে পারে, তবে তিনি জীবনের সমস্ত দ্বন্দ্ব ও ভয় থেকে মুক্ত হতে পারেন।

ঈশ্বরের ভক্তি:

শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে ঈশ্বরের প্রতি অনন্য ভক্তি মানুষকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করে এবং তাকে চিরন্তন শান্তি দান করে।

সমতা ও সন্তুলন:

শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে জীবনে সমতা ও সন্তুলন বজায় রাখা উচিত। সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, প্রশংসা-নিন্দা সবকিছুকে সমভাবে গ্রহণ করা উচিত।

শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু ও তাঁর প্রভাব:

মহাভারতের শেষে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর দ্বাপর যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং কলিযুগের শুরু হয়। শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি কেবল একজন দেবতা নন, বরং তিনি মানবজীবনের এক আদর্শ প্রতীক। তাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে।

উপসংহার:

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন দার্শনিক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা, আধ্যাত্মিক গুরু এবং একজন অসাধারণ সামরিক কৌশলবিদ হিসেবে মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও উপদেশ মানুষের জীবনে আজও গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে।